বাংলাদেশে রসুন একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ দ্বি-বর্ষজীবী শুল্ককন্দ জাতীয় মসলা ফসল। বাংলাদেশে রসুনের চাষ সাধারণত রবি মৌসুমে সীমাবদ্ধ। শাক-সবজি, মাংস প্রভৃতি রান্নার এবং আচার, চাটনি প্রস্তুতে রসুন প্রায়ই ব্যবহৃত হয়। খাদ্য ছাড়াও রসুন অনেক ঔষধি গুণে গুণান্বিত। আয়ুর্বেদীয় মতে রসুন ব্যবহারে শরীরের খোস-পাঁচড়া, অজীর্ণ, পেট ফাঁপা, পেটে বায়ু জমা, শুল বেদনা, হুদরোগ, অশ্ব, সর্দি, কাশি, টাইফয়েড, ডিপথেরিয়া, বাতরোগ ও যে কোন রকমের চর্ম রোগ নিবারণ হয়। রসুনে প্রতি ১০০ গ্রামে ৬২.০ গ্রাম পানি, ২৮.৮ গ্রাম শ্বেতসার, ৬.৩ গ্রাম প্রোটিন, ০.১ গ্রাম তেল, ১.০ গ্রাম খনিজ পদার্থ, ০.৮ গ্রাম আঁশ এবং ভিটামিন ‘সি’ থাকে। রসুনের তেলে সালফার জাতীয় পদার্থ আছে। অ্যালিন ও ডাই এলিল ডাইসালফাইড থাকায় রসুনের একটি বিশেষ গন্ধ আছে।
মাটি ও জলবায়ুঃ
পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাযুক্ত উর্বর দো-আঁশ মাটিতে রসুন ভাল জন্মে। এঁটেল বা এঁটেল-দোআঁশ মাটিতেও এর চাষ হতে দেখা যায়। তবে এঁটেল মাটির কন্দ সুগঠিত হয় না এবং ফসল তোলার সময় অনেক কন্দ থেতলে যায় বলে বেশিদিন ঘরে রাখা যায় না। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে রসুন ভাল জন্মে। রসুন লাগানোর পর অতিরিক্ত গরম, মেঘলা আবহাওয়া বা বেশি বৃষ্টিপাত হলে কন্দ ভালোভাবে গঠিত হয়না। এইজন্য অধিকাংশ স্থানে শীতকালে রসুনের চাষ হয়। রবি মৌসুমে রসুনের কন্দ উৎপাদনের জন্য তাপমাত্রা ১৫° সে. এবং আপেক্ষিক আদ্রতা ৭০% হলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
জমি তৈরীঃ
রসুনের জমি ৪-৫টি চাষ ও মই দিয়ে আগাছা বেছে এবং ঢেলা ভেঙ্গে মাটি ঝুরঝুরে করা হয়।
জাতঃ
বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় জাতের রসুনের চাষাবাদ হয়। রসুন দু’রকমের, একটি এক কোয়ার এবং অন্যটিতে অনেকগুলো কোয়া একসঙ্গে থাকে। সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত বারি রসুন ১ ও বারি রসুন ২ এর আবাদ মাঠ পর্যায়ে শুরু হয়েছে। বর্তমান রসুনের আরো উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনের জন্য বিজ্ঞানীরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বীজের মাত্রাঃ
বীজ হিসেবে রসুনের কোয়া ব্যবহৃত হয়। রসুনের কন্দ হাতে ভেঙ্গে এই কোয়া পৃথক করা হয়। বীজের জন্য ০.৯ থেকে ১.১ গ্রাম ওজনের কোয়ায় ফলন বেশী পাওয়া যায়। কোয়ার আকার অনুযায়ী বিঘা প্রতি ৬০-৯০ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।
বপনঃ
বাংলাদেশে সর্বত্র শীতকালে রসুনের চাষ হয়। সাধারণত সমতল ভূমিতে ১৫ই অক্টোবর ১৫ই নভেম্বর (কার্ত্তিক-অগ্রহায়ণ) মাসে রসুনের চাষ হয়।
বপন পদ্ধতিঃ
জমি তৈরির পর সমতল করে সেচের সুবিধার জন্য ছোট ছোট খন্ডে বিভক্ত করা হয়। পরে এই ছোট জমি খন্ডে উপর অথবা ১৫ সেমি অন্তর ৫-৬ সেমি গভীর নালা করে ৮-১০ সেমি দূরে রসুনের কোয়া হাতে লাগানো হয়। কোয়ার অংকুরিত অগ্রভাগ উপরের দিকে রেখে, মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। বাংলাদেশে কোন কোন স্থানে রসুনের কোয়া ছিটিয়ে বোনা হয়।
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতিঃ
রসুনের জমিতে জৈব সার প্রযোগ করে ভালো ফলন পাওয়া যায় বলে জমি তৈরীর সময় বিঘা প্রতি ৬০০ কেজি গোবর বা আবর্জনা পঁচা সার প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। রসুনের জন্য বিঘা প্রতি মোটামুটি ২০ কেজি নাইট্রোজেন, ১০ কেজি সালফার ও ২৪ কেজি পটাশের প্রয়োজন হয়। এই সারের অর্ধেকটা শেষ চাষের সময় এবং বাকী অর্ধেক কোয়া লাগানোর ১ মাস পরে চারার চারিদিকে ছড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। তাছাড়া শেষ চাষের সময় ৩০ কেজি সিঙ্গল সুপার ফসফেট প্রয়োগ করতে হবে।
সেচঃ
রসুনের কোয়া লাগিয়েই একবার সেচ দেওয়া হয়। এর পর চারা বের না হওয়া পর্যন্ত ২-৩ দিন অন্তর সেচ দেওয়া উচিত। চারা একবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে ১০-১৫ দিন অন্তর সেচ দিলেও চলে। রসুনের জমিতে কন্দ গঠনের সময় উপযুক্ত পরিমানে রস থাকা দরকার। সুতরাং রসুনের সম্পূর্ণ জীবনকাল পানির অভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে। রসুন কোনা অবস্থাতেই পানিবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। সেচ প্রয়োগের ৩০-৬০ মিনিট পর সেচ নালা খুলে দিতে হবে। পানি সেচ অবশ্যই ফসল উত্তোলনের ৩ সপ্তাহ পূর্ব থেকে বন্ধ রাখতে হবে।
পরবর্তী পরিচর্যাঃ
রসুনের চারা যখন বড় হতে থাকে তখন জমিতে আগাছা জন্মিতে পারে। কন্দ গঠনের আগ পর্যন্ত ২-৩টি নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিস্কার ও মাটি আলগা করে দেওয়া উচিত। রসুনের জমিতে হাল্কাভাবে নিড়ানি দেওয়া প্রয়োজন, যাতে শিকড় ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। রসুনের ক্ষেতে মাটির চটা কন্দের বৃদ্ধিতে বাঁধাগ্রস্থ করে। তাই সেচের পর মাটির চটা ভেঙ্গে দিতে হবে। প্রতিবারই ক্ষেতে নিড়ানির পর ঝুরঝুরা মাটি দিয়ে গাছের গোড়া ঢেকে দিতে হবে।
রোগ ও পোকামাকড় দমনঃ
রসুনের রোগবালাইয়ের মধ্যে ব্লাইট, ডামপিং অফ, পারপোল ব্লচ, মাঝে মাঝে ডাউনি মিলডিউ দ্বারা আক্রান্ত হতে দেখা যায়। এ সমস্ত রোগ দমনের জন্য রোর্দোমিক্সার (তুঁতেঃচুনঃপানি= ১:১:১০০) বা রোভরাল স্প্রে করে সহজেই দমন করা যায়। রসুন ভাইরাস দ্বারা মারাত্মক ভাবে আক্রান্ত হয়ে থাকে। তবে বাউ রসুন ১ এ উক্ত রোগ হয় না বললেই চলে। রসুন সাধারণত থ্রিপস, রেড স্পাইডার ও মাইট দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। এ সব পোকা দমনের জন্য ম্যালাথিয়ন/ডেসিস/ডাইমেক্রন প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২৫ মিলি হারে স্প্রে করে সহজেই দমন করা যায়।
রসুন সংরক্ষণকালে সিগাটোগা বিটল, লিপিডপটেরা বোরার ও ব্লাক মোল্ড/শুটিমোল্ড দ্বারা আক্রান্ত হয় যা ফিউমিগেট দিয়ে দমন করা যায়।
জীবনকালঃ
১২০-১৫০ দিন।
ফসল তোলাঃ
সাধারণত রসুন লাগানোর দুই মাস পরে গাছে কন্দ গঠিত হতে থাকে। ৩-৩.৫ মাস পরে কন্দ পুষ্ট হয়ে পাকতে আরম্ভ করে। ফসল পাকলে পাতার অগ্রভাগ হলদে বা বাদামী হয়ে শুকিয়ে যায়। কন্দের বাইরের দিকে কোয়াগুলি পুষ্ট হয়ে লম্বালম্বি হয়ে ফুলে উঠে এবং দুইটি কোয়ার মাঝে খাঁজ দেখা যায়। এই সময়ই রসুন তোলার উপযুক্ত হয়। গাছ হাতে টেনে তুলে, মাটি ঝেড়ে পরিস্কার করা হয়। এরপর কন্দগুলি ৩-৪ দিন ছায়ায় রেখে শুকানো হয়। তারপর কন্দ থেকে কান্ড কেটে গুদামজাত করা হয়।
ফলনঃ
আমাদের দেশে জাতীয় গড় উৎপাদন বিঘা প্রতি ৪০০ কেজির কম। ভাল জাত, সার ও সেচ প্রয়োগে চাষ করলে বিঘা প্রতি ২০০০ কেজি পর্যন্ত ফলন পাওয়া সম্ভব।
সংরক্ষণঃ
ভালভাবে শুকানো রসুন আলো-বাতাস চলাচলযুক্ত ঘরের শুকনা মেঝেতে বা মাচায় সহজেই ৫-৬ মাস রাখা যেতে পারে। হিমাগারে ০-২ সে. তাপমাত্রায় এবং শতকরা ৬০-৭০ ভাগ আদ্রতায় রসুন সবচেয়ে ভালভাবে ও বেশিদিন রাখা যায়। বেনী বেঁধে ঝুলিয়ে রাখলে রসুনের গুনাগুণ ও মান তুলনামূলকভাবে ভালো থাকে।
সূত্রঃ মরিচ,পেঁয়াজ,রসুন,হলুদ ও আদা উৎপাদনের উন্নত কলাকৌশল (বারি)।
Garlic Cultivation, Spice Cultivation