বিশ্ব এখন ইন্টারনেটের ওপর অনেকখানি নির্ভরশীলÑ এ কথা বললে খুব বেশি বলা হবে না এবং যত দিন যাবে নির্ভরশীলতা তত বাড়বে; আর এ কারণেই বিশ্বে এখন সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে ইন্টারনেট ভক্ত এবং সব কাজেই ইন্টারনেটের প্রয়োজন।
সিসকো পরিচালিত গবেষণা ইনডেক্স অনুযায়ী আগামী ২০১৬ সালের মধ্যে ইন্টারনেট ট্রাফিক ১.৩ জেটাবাইটস ব্যান্ডউইথড ছাড়িয়ে যাবে। এ কারণ ভবিষ্যতে বহনযোগ্য পণ্য, স্মার্টফোন এবং ডিজিটাল পণ্যগুলোতে ইন্টারনেটের ব্যবহার নিশ্চিত হবে। তখন ইন্টারনেট বিস্ফোরণের মতো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যাবে। ২০১৬ সাল নাগাদ আলাদাভাবে ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক ১ হাজার ৮৯০ কোটি সংযোগ ছাড়িয়ে যাবে। তখন প্রতিজনের জন্য গড়ে ২.৫টি ইন্টারনেট সংযোগ থাকবে। ২০১১ সালের হিসাবে এ সংখ্যা ১ হাজার ৩০ কোটি। ইন্টারনেট কী : ইন্টারনেট (ওহঃবৎহবঃ, বাংলায় আন্তর্জাল) হলো পৃথিবীজুড়ে বিস্তৃত পরস্পরের সাথে সংযুক্ত অনেক কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সমষ্টি যা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত এবং যেখানে আইপি বা ইন্টারনেট প্রটোকল নামের এক প্রামাণ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে ড্যাটা আদান-প্রদান করা হয়। ইন্টারনেট এবং ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব সমার্থক শব্দ মনে হলেও তার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ইন্টারনেটের হার্ডওয়্যার ও সফ্টওয়্যার পরিকাঠামো কম্পিউটারগুলোর মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক তথ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করে। বিপরীতে ওয়েব ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রদত্ত পরিসেবাগুলির একটি। এটা পরস্পর সংযুক্ত কাগজপত্র ও অন্যান্য সম্পদ সংগ্রহের, হাইপারলিংক এবং ইউআরএল দিয়ে সংযুক্ত। যাত্রা শুরু : ১৯৬০-এর দশকে মার্কিন সামরিক বাহিনীর গবেষণা সংস্থা অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্ট্স এজেন্সি বা আরপা পরীামূলকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগারের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। প্যাকেট সুইচিং পদ্ধতিতে তৈরি করা এই নেটওয়ার্ক আরপানেট নামে পরিচিত ছিল। এতে প্রাথমিকভাবে যুক্ত ছিল স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট লস অ্যাঞ্জেলেস, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট সান্তা বারবারা ও ইউনিভার্সিটি অফ ইউটাহ্। রাজনৈতিক শক্তি : ইন্টারনেট এখন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আÍপ্রকাশ করেছে। তিউনিসিয়া, মিসর প্রভৃতি দেশে ইন্টারনেটভিত্তিক প্রযুক্তির কারণেই বিপ্লব ঘটতে পেরেছে। বাংলাদেশের সাংবাদিকরাও এখন নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে প্রফাইল ছবির বদলে কালো ‘জে’ ব্যবহার করে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখন আর স্বৈরাচারেরা যেকোনো কাজ করে সহজে পার পেতে পারে না। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফের নির্বিচারে বাংলাদেশী হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে হ্যাকারদের ভারতীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হ্যাক করাটাও ছিল একটি রাজনৈতিক প্রতিবাদ। ইন্টারনেট থেকে টাকা আয় : রাজধানীসহ সারা দেশে এখন ইন্টারনেটে টাকা আয়ের ধুম দেখা যাচ্ছে। ইন্টারনেটের সঙ্গে কিছুটা পরিচিত এমন ছাত্র-শিক্ষক, চাকরিজীবী, বেকার, গৃহিণী সবাই যেন এতে মেতে উঠেছেন, তাদের কাছে ক্লিক করলেই ডলার। দেয়ালে দেয়ালে পোস্টারসহ এমন প্রচারণা চলছে, যেন ডলার হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে আপনার কম্পিউটারের মাউসে ক্লিক করলেই আপনার হাতে চলে আসবে রাশি রাশি। সত্যিই কি তাই? সত্যি। তবে সাধারণ মানুষ ক্লিক করে টাকা আয়ের যে শর্ট-কাট পথের আশ্রয় নিচ্ছে, সেই পথ না মাড়ানোই ভালো, বিশেষ করে আপনার কষ্টের টাকা বিনিয়োগ করে। প্রাথমিক কিছু বিনিয়োগ করে বস্তা বস্তা ডলারের যে স্বপ্ন দেখা যায়, তার অনেকটাই মাল্টিলেভেল মার্কেটিং ব্যবসা। আপনার ও আপনার পরিচিতদের টাকা আত্মসাতের ডিজিটাল কৌশল। এ ক্ষেত্রে একটি পরামর্শ দেয়া যায়Ñ সেসব প্রতিষ্ঠান আগাম কিছু বিনিয়োগ করতে বলে সেখানে না যাওয়াই ভালো। তবে হ্যাঁ, ইন্টারনেট থেকে টাকা কামানো যায় আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে। সেজন্য আপনাকে গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রগ্রাম শিখতে হবে। লেখালেখিসহ (সাধারণত বাংলায় নয়) নানা কাজ আছে। আপনি যেটা ভালো জানেন, তা দিয়ে আবেদন করতে পারেন। হুমকিও বটে : ইন্টারনেটের বিরুদ্ধে একটি বড় অভিযোগ হলো এর ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা বখে যাচ্ছে। তারা শিক্ষামূলক কিছু না দেখে অশ্লীল ভিডিও এবং ছবি দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা বিশ্বেই এমনটা হচ্ছে। সম্প্রতি বিভিন্ন বার্তা সংস্থা লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের অধ্যাপক সোনিয়া লিভিংস্টোনের একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বেরিয়ে এসেছে মধ্যবিত্ত পরিবারের অভিভাবকরা সাধারণত তাদের সন্তানদের ইন্টারনেট ব্যবহারে বেশি বেশি উদ্বুদ্ধ করে থাকেন। একপর্যায়ে ছেলেমেয়েরা অশ্লীল দৃশ্য দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও পর্নোর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। ফলে সামাজিক আচরণ বিলোপসহ নানা রকমের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে তারা। জরিপে অংশ নেওয়া ১০০০ ছাত্রছাত্রীর ৫১ শতাংশ বাড়ির কাজ না করে, পরিবার পরিজন দূরে রেখে ইন্টারনেটে অতিরিক্ত সময় কাটায়। বিশেষ করে ১৪ থেকে ১৬ বয়সের তরুণীদের এ প্রবণতা অনেক বেশি। বিশেষ করে যাদের শোয়ার ঘরে ইন্টারনেট সুবিধা রয়েছে তারা হুমকির মুখে রয়েছে। এতে আরো জানা যায়, ৩০ শতাংশ ধনী পরিবারের ছেলেমেয়েদের বিপরীতে ২৫ শতাংশ মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান অশ্লীল ভিডিওতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। পর্নো বার্তা পাঠানোর ক্ষেত্রেও মধ্যবিত্ত ছেলেমেয়েরা অন্যদের তুলনায় এগিয়ে। এ সংখ্যা ১৭:১৪। ৪০ শতাংশ বাবা-মা তাদের সন্তানরা ইন্টারনেটে কী করছে সে ব্যাপারে সচেতন। বিপরীতে ২৯ শতাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারের মা-বাবা এ ব্যাপারে অসচেতন। এটিকে গবেষক ভীতির সংস্কৃতি বলে আখ্যা দিয়েছেন। যে সংস্কৃতিতে পিতামাতা তার সন্তানকে বাইরে বের হতে না দিয়ে প্রযুক্তির প্রতি বেশি মুখাপেক্ষী করতে উদ্বুদ্ধ করছেন। তবে এখনও সমস্যাগুলো সর্বত্র দেখা না যাওয়ায় এ নিয়ে অভিভাবকদের খুব বেশি উদ্বিগ্ন না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন গবেষক।