প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না
গত পর্বে আমরা সরল পথের কথা বলেছিলাম যেটি আমাদের এই জীবনে অনুসরণ করতে হবে যাতে আমরা পরকালে সহজে পুলসীরাত পার হতে পারি। আমরা তখন সূরা ফাতিহায় আরও নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করি আমরা কোন সরল পথের সন্ধান চাই। আমরা বলিঃ
صراط الذين أنعمت عليهم
“তাদের পথ যাদের প্রতি আপনি অনুগ্রহ করেছেন”
আমরা যখন এই আয়াতটি পড়ব, আমাদের অন্তরকে নরম করব, কারণ আমরা সেই নবী (আঃ) গণ, রাসুল (সাঃ), সাহাবাগণ (রাঃ), সত্যের পথ অনুসরণকারীগণের কথা স্মরণ করছি যাদের উপর আল্লাহ তায়ালা তাঁর বিশেষ রহমত নাযিল করেছেন। এই আয়াতটি পড়ে আমরা স্বস্তি পাই কারণ আমরা জানতে পারি, যারা এই সরল পথ অবলম্বন করে চলেন আল্লাহ তাদের সাথে থাকেন; কাজেই যখন অন্যেরা আপনাকে নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, আপনার আকীদার ব্যপারে লজ্জিত হবেন না। অথবা আপনার মদ্যপান না করা, দাড়ি-টুপি পড়া বা হিজাব পড়া নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, কুঁকড়ে যাবেন না। কুরআনের অনেক সূরাতে আমরা নবীগনের এমন কাহিনী পাই, যা আমাদের রাসুল (সাঃ) কে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য নাযিল করা হয় যখন তিনি কঠিন বিপদের সম্মুখীন হতেন। এই আয়াতটিও আমাদের জন্য ঠিক তেমনই হওয়া উচিত- আমাদের মনে রাখা উচিত আমরা যতক্ষণ সরল পথ অনুসরণ করব, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।
এই আয়াতের বাকী অংশে আমরা পড়িঃ
غير المغضوب عليهم ولا الضالين
“তাদের পথ নয় যাদের উপর আপনার গজব বর্ষিত হয়েছে এবং তাদেরও নয় যারা পথভ্রষ্ট।”
তারা কারা যাদের উপর আল্লাহর গজব বর্ষিত হয়েছে? ইবনে কাসীর বর্ণনা করেন এরা তারা যারা সব কিছু জেনেও তা অনুসরণ করে না। আর পথভ্রষ্ট তারা যারা জ্ঞান রাখে না। আমাদের এই দুই পথ সম্পর্কেই সাবধান থাকতে হবে যাতে আমরা এর কোন একটিও অনুসরন না করি। কাজেই সরল পথে থাকতে হলে আমাদের জ্ঞান এবং আমল দুটোরই সমন্বয় করতে হবে।
সূরা ফাতিহা আমাদের সঠিকভাবে দোয়া করার পদ্ধতিও শিখিয়ে দেয়- যে আমরা প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা দিয়ে দোয়া শুরু করব, তারপর আমাদের প্রয়োজনের কথা বলব।
আমীন
আমরা গত পর্বে ‘আমীন’ বলা প্রসঙ্গে সংক্ষেপে জেনেছি, যে আমরা কিভাবে আন্তরিকভাবে আল্লাহর কাছে আকাঙ্খা করব যেন তিনি আমাদের সূরা ফাতিহায় যা চাওয়া হয়েছে তা দেন। আবার আমরা যখন আমীন বলি তখন অন্য ব্যপারও ঘটে। আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসুল (সাঃ) বলেছেন-
“যখন ইমাম বলবে ‘গাইরিল মাগদুবি ‘আলাইহিম ওয়ালাদ্দ-ল্লীন’ তখন তোমরা বলবে ‘আ-মীন’- অর্থ আল্লাহ আপনি কবুল করুন। যার পড়া ফেরেশতাদের পড়ার সময়ের সাথে মিলে যাবে, তার পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।” (সহীহ বুখারীঃ ৪১২৩ ইফা)
আমরা যখন আমীন বলি যার অর্থ ‘হে আল্লাহ কবুল করুন’, ফেরেশতারাও বেহেস্তে আমীন বলে, আর তা যদি আমাদের বলার সাথে মিলে যায় তাহলে আল্লাহ আমাদের পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেবেন। একারনেও আমাদের সমস্ত অন্তঃকরণ দিয়ে এটা বলা উচিত- যাতে আল্লাহ আমাদের আন্তরিক দোয়া কবুল করেন এবং আমাদের গুনাহ সমূহ মাফ করে দেন।
কুরআন
আমরা সূরা ফাতিহা পড়ার পর ছোট কোন সূরা তেলাওয়াত করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মাঝে মাঝে আমরা নামাজে অতিঅভ্যস্ততার কারণে মনেও করতে পারি না কোন সূরা পড়ে ফেলেছি। আমাদের যাদের এই সমস্যা আছে, তাদের আল্লাহর এই কথা গুলো স্মরণ করা উচিত যে, আল্লাহ বলেছেন –
أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا
তারা কি কোরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে না? না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ? (সূরা মুহাম্মাদঃ ২৪)
মুহাম্মাদ বিন কা’ব আল ক্কারযী বলেন- রাত থেকে ভোর পর্যন্ত সূরা যালযালা থেকে সূরা ক্কারিয়াহ পড়া এবং তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা আমার কাছে চিন্তাবিহীন সমগ্র কুরআন পড়ার চেয়ে বেশী পছন্দনীয়।
ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর একজন প্রতিবেশী বর্ণনা করেন যে, যখন ইবনে আব্বাস (রাঃ) রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেন তখন তিনি একটি আয়াত তেলাওয়াত করে থামতেন। আবার কিছুক্ষন পর আরেকটি আয়াত তেলাওয়াত করে থামতেন। প্রতিবেশীটি তাকে এরূপ করার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, তিনি এরূপ করতেন যাতে আয়াতের কথাগুলোর প্রতি তিনি মনোনিবেশ করতে পারেন। আমরা প্রায়ই গুনগত মানের চেয়ে পরিমানের দিকে বেশী প্রাধান্য দেই। আমরা কেউ কেউ পুরো এক পারা কুরআন তেলাওয়াত করে ফেলি, অথচ এর পর যদি কেউ প্রশ্ন করে এই পারা পড়ে কি কি শিখলাম, হয়তো কিছুই বলতে পারি না। ইবনে কাইয়্যিম বলেন কেউ যদি কুরআন পড়ে লাভবান হতে চায়, সে যেন নিশ্চিত করে যে তার অন্তরও তারা সাথে উপস্থিত আছে; সে যেন আল্লাহর কথাগুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে তেলাওয়াত করে বা শ্রবণ করে, এটা যেন ভাবে যে আল্লহ তাকেই উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলছেন।
আল্লাহর এই সব কালাম এতই শক্তিশালী যে আল্লাহ বলেন-
لو أنزلنا هذا القرآن على جبل لرأيته خاشعاً متصدعاً من خشية الله
“যদি আমি এই কোরআন পাহাড়ের উপর অবতীর্ণ করতাম, তবে তুমি দেখতে যে, পাহাড় বিনীত হয়ে আল্লাহ তা’আলার ভয়ে বিদীর্ণ হয়ে গেছে।” (সূরা আল হাশরঃ ২১)
সুবহানাল্লাহ, আল্লাহ আমাদের জন্য কেমন রূপক উপস্থাপন করেছেন। কেমন করে কুরআনের ওজন বুঝিয়েছেন; যা আমরা প্রতিদিন তেলাওয়াত করে যাই কিন্তু মোটেও অনুধাবন করি না যে কথাগুলো আমাদের উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে এবং আমাদের পথপ্রদর্শনের জন্য বলা হয়েছে। আমরা অনেকেই বলি যে আমরা তো আরবী ভাষা বুঝি না, অথচ আমাদের নামাজে পড়ার জন্য কিছু সূরা বা কিছু আয়াত অন্ততঃ মুখস্থ করা আছে। আমাদের সেই সব সুরা বা আয়াতের তাফসীর পড়তে হবে যাতে আমরা তার অর্থগুলো বুঝতে পারি এবং তা তেলাওয়াত করার সময় আমাদের অন্তর তার দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। আমরা যদি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হই যে প্রতি সপ্তাহে অন্ততঃ কয়েক পৃষ্ঠা করে যে সূরা গুলো জানি তার তাফসীর পড়ব তাহলে বেশী সময়ও লাগবে না। আমরা কয়েকজন একত্র হয়েও এই কাজ করতে পারি এবং জামা’আতে আল্লাহর কালাম নিয়ে চিন্তাভাবনা করার জন্য তাতে বরকতও লাভ করতে পারি।
ইবনে কাইয়্যিম বলেন, আমাদের মধ্যে ভালবাসা, ভয় এবং আশা এই তিন অনুভূতি থাকতে হবে। আমরা যখন আল্লাহর রহমত বিষয়ক আয়াত পড়ব তখন আমাদের জীবনে আল্লাহর রহমতের কথা স্মরণ করে অন্তরে ভালবাসা অনুভব করতে হবে। যখন আমাদের পূর্ববর্তীদের কথা পড়ব ও তাদের উপর আসা শাস্তির কথা পড়ব, তখন আমাদের অন্তরে এই ভেবে ভয় অনুভব করতে হবে যে আমরাও তাদের অনুরূপ শাস্তি পেতে পারি। যখন আমরা এমন আয়াত পড়ব যেখানে আল্লাহর ক্ষমার কথা বলা হয়েছে, তখন আমরা আশান্বিত হব আল্লাহর দয়ার কথা ভেবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, নামাজ কোন একতরফা কথামালা নয়, নামাজ হল আল্লাহর সাথে একান্তে কথোপকথন। আর কুরআন হল আমাদের উদ্দেশ্য করে আল্লাহর বানী।
আল্লাহ যেন আমাদের কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে ও তা থেকে শিক্ষা নিতে সাহায্য করেন এবং নামাজে আমাদের অন্তর কে সামিল করার তৌফিক দেন। আমীন।
অন্যান্য পর্ব গুলো এই লিংক থেকে পড়ুনঃ
পর্ব ১।পর্ব ২।পর্ব ৩।পর্ব ৪।পর্ব ৫।পর্ব ৬।পর্ব ৭।পর্ব ৮।পর্ব ৯।পর্ব ১০।পর্ব ১১।পর্ব ১২।পর্ব ১৩।পর্ব ১৪।পর্ব ১৫।পর্ব ১৬।পর্ব ১৭।পর্ব ১৮।পর্ব ১৯।পর্ব ২০।পর্ব ২১।পর্ব ২২।পর্ব ২৩।পর্ব ২৪।পর্ব ২৫।পর্ব ২৬।পর্ব ২৭।পর্ব ২৮
সংগ্রহিত (কোরআনের আলো) সাইট থেকে।