এফএনএস ॥ হাদিসে উল্লেখ রয়েছে যখন রমজান প্রবেশ করে তখন জান্নাতের দরজা খুলে যায়,
জাহান্নামের দরজা বন্ধ হয়ে যায় এবং শয়তানগুলো শৃংখলে আবদ্ধ হয়। বাংলাদেশের মুসলমানদের দিকে
দৃষ্টি ফেরালে দেখা যায় রমজানে এবং ঈদের আগে ভালো খাবার, নতুন দামি কাপড়, আত্মীয়-স্বজনের
উপহারসামগ্রী, ফ্রিজ, কালার টিভি তথা আসবাবপত্রের মডেল পরিবর্তন করা ইত্যাদির ব্যবস্থা
হয় রমজানের প্রস্তুতি। যে কারণে এ দেশের অধিকাংশ লোকের অতিরিক্ত উপার্জন করা প্রয়োজন

পড়ে। ফলে রমজানের প্রস্তুতিস্বরূপ রমজানের আগেই সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীরা অফিসের
টেবিলে ফাইলে উৎকোচের রেট বাড়িয়ে দেন, ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ভোগ্যপণ্যের
দাম বাড়িয়ে দেন, আইন-শৃংখলা বাহিনীর সহযোগিতায় চোরাচালান বেড়ে যায়, রাস্তায় গাড়ি
আটকিয়ে উৎকোচ নিতে নিতে রোড জ্যাম হয়ে শহর চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে, চুরি,

ডাকাতি,
ছিনতাই এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামা বেড়ে যায়, সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খায়, বিরোধী
দল সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চেষ্টা করে। খুশির কথা, রমজানের প্রথম দিকে অতিরিক্ত মৌসুমী
মুসল্লিদের ভিড়ের কারণে মসজিদের বারান্দার সামনে রাস্তায় ও নামাজে দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া
যায় না। অথচ এক সপ্তাহ পরেই অনেক মসজিদের কাতার খালি পড়ে থাকে। এ হচ্ছে আমাদের রমজানের
প্রস্তুতি। এসব প্রস্তুতি মূলত দুনিয়া তথা তাগুত প্রেমের প্রস্তুতি। এই প্রস্তুতির কারণে
রমজানে শয়তানগুলো শৃংখলে আবদ্ধ থাকে শীর্ষক হাদিসটি বাংলাদেশে অসাড় প্রমাণিত হচ্ছে।
সিয়াম সম্পর্কে আমাদের সঠিক জ্ঞানের অভাব এ অবস্থার জন্য অনেকাংশে দায়ী। সিয়াম শব্দের বাংলা
কী? সিয়ামে হাকিকত কী? সিয়াম পালনের উদ্দেশ্য কী? অধিকাংশ মুসলি তা জানে না। আমাদের
সমাজের আলেমরা আনুষ্ঠানিক বন্দেগিকে একমাত্র বন্দেগি হিসেবে প্রচার করে এবং আনুষ্ঠানিক
বন্দেগির মাধ্যমে আল্লাহকে খুশি করে মরার পরে বেহেশত পাওয়া যাবে, এমন ধারণা দিয়ে থাকেন,
গবেষণা বা ধ্যানের মাধ্যমে সঠিক ধর্ম উপলব্ধির পরামর্শ রাখেননি, বাজারে যেসব ধর্মীয় পুস্তক
পাওয়া যায়, তা একমাত্র আনুষ্ঠানিক বন্দেগি সংক্রান্ত পুস্তক। এমনকি মাদরাসার সিলেবাসেও এলমে
তাছাওউফ পাঠ ও চর্চা শিথিল করা হয়েছে, যা কোন রাজনৈতিক কারণ কি না তা আল্লাহই ভালো
জানেন।


আল্লাহ বলেছেন, রমজান আমার জন্য, তাই আমি নিজ হাতে এর প্রতিফল দান করি, আমি নিজেই
সিয়াম সাধনার প্রতিফল। সিয়াম সাধানায় সায়েম, সিদ্ধি লাভ করলে অর্থাৎ সাধু হতে পারলে
রমজানের গোল অর্থাৎ পুরস্কার (আল্লাহকে) পাবেন।
আল্লাহ অসীম, আমরা সব সৃষ্টিই সসীম। এই সসীম, অসীম থেকেই এসেছে। আবার অসীমেই
ফিরে যেতে হবে, বিন্দু সিন্ধুতে উপনীত হবে। তাই আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমরা আমার কাছে
ফিরে আসবে। আবার কোথাও বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের প্রত্যাবর্তন স্থল আমারই নিকট।’
অর্থাৎ পদার্পণ করেছ, প্রত্যাবর্তন করবে। এই প্রত্যাবর্তনের অর্থাৎ ফিরে যাওয়ার পথ প্রদর্শনের
জন্য যুগে যুগে, হাদি/মোর্শেদ থাকেন। যারা অসীমে অর্থাৎ আল্লাহতে ফিরে যেতে চান তারা
মোর্শেদের অনুসারী হয়ে সিয়াম সাধনায় রত থেকে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আল্লাহপ্রাপ্ত হন।
আল্লাহ নিজে পাক। মানব সত্তা পাক এবং নাপাকের সমন¦য়। অতএব, আল্লাহকে পেতে হলে পুরোপুরি
পাক হতে হবে। (আল্লাহ সত্তা+নফস সত্তা)= মানব সত্তা। মানব অন্তরে শয়তান প্রবেশ অধিকার পাওয়ায়
আমাদের নফস বা প্রবৃত্তির সঙ্গে শয়তান মিশে আছে। এখন শয়তানকে না সরাতে পারলে আল্লাহকে
পাওয়া যাবে না বা অসীমে মেশা যাবে না। শয়তানকে সরানোর মাসই রমজান। আল্লাহ বলেন, ‘ইয়া
আইয়্যুহাল্লাজিনা আমানু কুতিবা আলাই কুমুসসিয়ামা কামা কুতিবা আলাল্লাজিনা মিন
কবলিকুম লায়াল্লাকুম তাত্তাকুন’ অর্থ- হে আমানুগণ তোমাদের ওপর রোজাকে কিতাবস্থ করা
হল যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর যেন তোমরা মুত্তাকি হতে পার। সুরা বাকারা
আয়াত ১৮৩। মুত্তাকি হওয়া অর্থ শয়তানকে তথা তাগুতকে সরানো।
বাংলা উর্দুতে রোজা শব্দটি ব্যবহƒত হলেও রোজা ফার্সি শব্দ, আরবিতে সিয়াম। সিয়াম শব্দের
অর্থ প্রত্যাখ্যান, বর্জন, বিরত থাকা ইত্যাদি। যে ব্যক্তি বিরত থাকে তাকে সায়েম বা রোজাদার
বলে। এখন কথা হল, রোজাদার বা সায়েম কি প্রত্যাখ্যান করবে? বা কী হতে বিরত থাকবে? রোজাদার
তাগুত বা নফসের ধর্ম বর্জন করবে। নফস বা প্রবৃত্তির ধর্ম বর্জনই ক্রমান¦য় আমিত্ব বর্জন তথা
মরার আগে মরা। (আল্লাহর ধর্ম + নফসের ধর্ম)= মানব ধর্ম। আল্লাহর ধর্ম পালনকারীই রোজাদার, তথা
ধার্মিক। নফসের ধর্ম পালনকারী দুনিয়াদার, তথা বেরোজাদার। মানব ধর্ম থেকে নফসের ধর্ম সরাতে
পারলে শয়তান সরে যাবে, তখন রমজানের শেষের দিকে কদর রাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে ওই সায়েমের প্রতি
মানুষের জন্য পথ, সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে কোরআন নাজিল হয়। সুরা বাকারা, আয়াত-১৮৫।
সংক্ষেপে এই তো সিয়াম বা রোজার হাকিকত। শুধু নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে পান আহারের বিধি-
নিষেধ ও আনুষ্ঠানিক কর্মের গ-িতে সিয়াম আবদ্ধ নয়। সালাত, সিয়াম শুধু আনুষ্ঠানিকতা ও
সময়ের গ-িতে আবদ্ধ থাকলে বিভিন্ন মাজহাবের লোকের বিভিন্ন রকম অঙ্গভঙ্গিতে ও বিভিন্ন

সময় সালাত, সিয়াম দুরস্থ হতো না। সিয়ারা সুন্নিদের ইফতারের ১৫ মিনিট পর ইফতার করে।
এতে সিয়ারা মনে করে সুন্নিদের রোজা অল্প সময়ের জন্য সম্প�র্ণ নষ্ট হয়ে যায়। সালাত, সিয়াম
আনুষ্ঠানিকতা ও সময়ের গ-িতে আবদ্ধ থাকলে সব মাজহাবের লোকের নামাজ-রোজার সময় ও
অঙ্গভঙ্গি একই হতো এবং কোন মাজহাবের জন্ম হতো না।
নফস বা প্রবৃত্তির ধর্ম পরিত্যাগের অনুশীলনই সালাত। দীর্ঘ নয় মাস সালাতের মাধ্যমে তা-ত/নফস
বা দুনিয়া বর্জনের অনুশীলন করে একজন প্রকৃত সায়েম তার প্রেমময় বন্ধুর সঙ্গে মিলিত হওয়ার
বা তাকে পাওয়ার আশায় রজব ও শাবান মাসে মোর্শেদ বা গুরুর কাছ থেকে সিয়াম সাধনায় সিদ্ধি
লাভের কৌশল দীক্ষা লাভ করে, তার প্রেমে নিজেকে সিক্ত করে, বৈষয়িক কাজকর্ম গুছিয়ে কম খেয়ে,
কম ঘুমিয়ে, কম কথা বলে প্রেমময়ের প্রতীক্ষায় দর্শন ঘাটে দৃষ্টি নিবন্ধ রাখার, অর্থাৎ সিয়ামের
প্রেমময় প্রস্তুতি গ্রহণ করে।