সাওম শব্দটির বহুবচন সিয়াম। ফারসিতে সাওমকে রোজা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
ফারসি ভাষায় অধিকাংশ ইবাদতের শব্দ বাংলায় হুবহু ব্যবহার হয়ে থাকে। বাংলায় সাওম শব্দের অর্থ বিরত
থাকা বা থেমে যাওয়া! ইংরেজিতে সাওমের শাব্দিক অর্থ ব্রেক অর্থাৎ থামিয়ে দেয়া। ইসলামের
পরিভাষায় সাওম তথা সিয়াম শব্দের অর্থ সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব রকম পানাহার,
যৌনকর্ম ও সকল রকম মিথ্যাচার তথা অপকর্ম থেকে নিজকে দূরে সরিয়ে রাখার নাম সিয়াম সাধনা।
একটি বিবেকসম্পন্ন মানুষ তার মানসিক সুস্থতা, সৎ চিন্তা তাকওয়াভিত্তিক জ্ঞান বুদ্ধির
উৎকর্ষ সাধনের বাস্তব প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সিয়ামের মাধ্যমে। এ মর্মে মহান রাব্বুল আলামীন
ঘোষণা করেন, ইয়া আইয়্যুহাল্লাজিনা আমানু কুতিবা আলাইকুমুসসিয়ামু কামা কুতিবা
আ’লাল্লাজিনা মিন ক্বাবলিকুম লা আল্লাকুম তাত্তাকুন। অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ, তোমাদের
ওপর সাওম ফরজ করে দেয়া হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের (নবীদের উম্মতগণের) ওপর ফরজ করা
হয়েছিল। ফলে আশা করা যায় যে, তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার বৈশিষ্ট্য জাগ্রত হবে। (সূরা বাকারা,
আয়াত-১৮৩) পবিত্র কুরআনুল কারিমে এ ভাষণ থেকে স্পষ্টভাবেই বুঝা যাচ্ছে যে, সিয়াম আল্লাহর
ভীতি তথা আÍশুদ্ধি অর্জনের একটি সর্বশ্রেষ্ঠ প্রশিক্ষণ মাধ্যম। এ প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে যদি
কেউ এর অতুলনীয় শিক্ষা যথাযথভাবে উপলব্ধি করে তা আÍস্থ করতে পারে তাহলেই কেবল সিয়াম সাধনার
ইল্পিত লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে। এ মর্মে মহানবী (সা.) ঘোষণা করেন, আন আবিহুরাইরাতা (রা.)
ক্বয়ালা ক্বয়ালা নবী (সা.) মাললাম ইয়াদাউ ক্বাউলা যুর ওয়া আমালূবিহী লাইসলিল্লাহি হাজাতুন
ফি ইয়াদাআ তয়াম অয়া শারাবাহু অর্থাৎ আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত নবী (সা.) বলেছেন, সাওম
অবস্থায় কেউ যদি মিথ্যা কথা বলা ও তদনুযায়ী কাজ করা পরিত্যাগ না করে তবে ্তার শুধু খাদ্য ও পানীয়
পরিত্যাগ করায় (সাওম পালনে) আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই (সহিহ আল বুখারি)। মানুষ সাওম
পালনের দ্বারা যদি আল্লাহ ভীতি ও আÍশুদ্ধি অর্জন করতে না পারে তাহলে নিছক উপবাস পালনের দ্বারা কি
ফায়দা লাভ হতে পারে? তাকওয়া অর্থাৎ আল্লাহ ভীতি মানুষের অন্তরে সৃষ্টি হলেই কেবল শোষণ, জুলুম,
নির্যাতন, সন্ত্রাস, অন্যের অধিকার হরণ, লোভ-লালসাসহ যাবতীয় সামাজিক কুসংস্কার, অবিচার,
অন্যায়, গর্ব-অহংকার তথা দাম্ভিকতার করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হতে পারে। তাকওয়ার সংজ্ঞা এভাবে দেয়া
হয়েছে যে, একটি অতি সরু পথ তার দুদিকে কাঁটাযুক্ত সারিবদ্ধ বৃক্ষরাজি রয়েছে, সে পথ অতিক্রম
করতে হবে অথচ ঐ কাঁটাপথ অতিক্রমকারীর কাপড় মোটেও স্পর্শ করতে পারবে না। তাকওয়া সম্পন্ন
ব্যক্তি সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা ঘোষণা করেন, ক্বুল ইয়া ইবাদিল্লাজিনা আমানুত্তাকু
রাব্বাকুম লিল্লাজিনা আহসানু ফি হাজিহীদদুনইয়া হাসানাতু … অর্থাৎ (হে নবী) বল : হে
আল্লাহর বান্দাহরা যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের রবকে ভয় কর! যে সব লোক এ দুনিয়ায় সৎ আচরণ
গ্রহণ করেছে তাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে (সূরা যুমার, আয়াত-১০) বর্ণিত আয়াতে সৎ কাজ ও উত্তম
পদ্ধতি অবলম্বনে পূর্বশর্ত হলো তাকওয়া বা আল্লাহ ভীতি অর্জন করা।
মানুষের কামশক্তি তথা যৌন প্রবৃত্তি নিবারণের জন্য বিবাহ করে নারীর সংস্পর্শে আসা প্রয়োজন।
অন্যায় তথা অবৈধভাবে যৌনকামনা মিটাতে গিয়ে মানব সমাজে মারামারি, দ্বন্দ¡, সংঘর্ষ,
বেহায়াপনা, অশ্লীলতাসহ মহাবিপর্যয়ের সৃষ্টি করা হয়েছে। যার পরিণতিতে আল্লাহ রাব্বুল
আলামীনের পক্ষ থেকে অনেক জনপদের ওপর গজব নাজিল হয়েছে এবং তাতে অনেক জনগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন
হয়ে গিয়েছে। এজন্য প্রয়োজন আত্মনির্ভরতা লাভ করে তবেই স্ত্রী ও সন্তানাদির স্বপ্ন দেখা। এ
মর্মে মহানবীর (সা.) একটি হাদিস এভাবে বর্ণিত হয়েছে আন আলকামা (রা.) ক্বয়ালা বাইনা
আনা আমশী মাআ আব্দুল্লাহ ফাক্বয়ালা কুন্না মাআন্নাবী (সা.) ফাক্বয়ালা মানিসতাত্তাআল
বাআতা ফালইতায়াওযাজ ফাইন্নাহু আগাদ্দু লিলবায়ারি অয়া আহসানুলিল ফুরিজে অয়ামানলাম
ইয়াস তাতিয়্যি ফাআলাইহি বিসসাওমি ফাইন্নাহু লাহু বিযাউ অর্থাৎ আলকামা (রা.) থেকে
বর্ণিত তিনি বলেছেন, এতোদিন আমি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের সাথে পথ চলছিলাম। আব্দুল্লাহ
ইবনে মাসউদ বললেন, আমরা নবী (সা.)-এর কাছে উপস্থিত ছিলাম। নবী (সা.) বললেন, তোমাদের মধ্যে
যে ব্যক্তি বিয়ে করার সামর্থ্য রাখো তার বিয়ে করা উচিত। কেননা, বিয়ে চোখকে অবনতকারী ও
গুপ্তাঙ্গের হেফাজতকারী। আর যে বিয়ে করতে সমর্থ নয় তার সওম পালন করা কর্তব্য। কেননা সওম যৌন
তাড়নাকে অবদমিত করে রাখে (সহিহ আল বুখারি)। একদিকে মানুষের ব্যক্তি চরিত্র ও সামাজিক
কাঠামোকে কলুষমুক্ত রাখতে এ হাদিসের দিকনির্দেশনা যেমন অতি প্রয়োজনীয় তেমনি
অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের বিষয়টির প্রতিও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সিয়াম সাধনা শুধু যৌন
ুধা নিয়ন্ত্রণের কাজই করে না শরীরের অতিরিক্ত চর্বি, মেদভুরি, উচ্চ রক্তচাপসহ বহু উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ
করে।
মাহে রমজানের সাওমের বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত তাৎপর্যময়। পবিত্র কুরআনুল কারীমে এ মর্মে ঘোষণা করা
হয়েছে- শাহরু রামাদানাল্লাজি উনযিলা ফীহেল কুরআনুহুদাললিন্নাসি ওয়া বাইয়্যেনাতিমিনাল হুদা
ওয়াল ফুরক্বান অর্থাৎ রমজান মাস, এ মাসেই কুরআন নাজিল করা হয়েছে। (সূরা আল বাকারা আয়াত-
১৮৫) আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার এ ঘোষণার দ্বারাই পবিত্র রমজান মাসের মর্যাদা ও এ মাসের সিয়াম
সাধনার অপরিহার্যতা সুস্পষ্টভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে। বিশ্ববাসীর পথনির্দেশক সংবিধান আল-
কুরআনের নাজিলের এ মাস আল্লাহর রহমত মাগফিরাত ও নাজাতের এক মহা বারতা নিয়ে মানব জাতির
সামনে হাজির হয়েছে। এ মাসের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো সত্য ও মিথ্যার বিভেদ রেখা অঙ্কন করে দেয়
রমজানুল মুবারকের সিয়াম সাধনা। মূলত আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারীমের দ্বারা
হক্ব ও বাতিলেল পার্থক্য নির্ণয় করে বাতিলের বিরুদ্ধে হকের বিজয় সংবাদ দান করেছেন। এ মর্মে
মহাগ্রন্থ আল কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, জাআলহাক্কু ও যাহাকাল বাতিলু ইন্নাল বাতিলা কানা
যাহুকা। অর্থাৎ সত্য এসেছে বাতিল বা মিথ্যা অপসৃত হয়েছে নিশ্চয়ই বাতিল অপসৃত হবারই বিষয়।
মাহে রমজান সম্পর্কে মহান রাব্বুল আলামীনের এ ভাষণ এ মাস এবং এ মাসের সিয়াম সাধনাকে
খুবই তাৎপর্যবহ করে তুলেছে। মহান রাব্বুল আলামীন বলেন, ফামান শাহিদা মিন ক্বুমূশশাহরা
ফালইয়াসুমহু। অর্থাৎ অতএব এখন থেকে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে তার জন্য এ সম্প�র্ণ মাসটি সাওম
পালন করা অপরিহার্য (সূরা বাকারা, আয়াত-১৮৫)। রমজান মাসে সিয়াম সাধনার অপরিহার্যতা শুধু
আল্লাহর হুকুম এ জন্যই পালনীয় সে কথা অবশ্যই ঠিক তবে এর ফায়দা বান্দার জন্যও অফুরন্ত এর ফাজায়েল
সম্পর্কে মহানবীর (সা.) হাদিসসমূহ এভাবে এসেছে, ইজাদাখালা শাহরু রামাদান ফুতিহাত
আবওয়াবু সাবআ সামায়াউ অয়া গুল্লিযাতুন্নারু অয়া ছুলসুলা তিশ শাআতিন। অর্থাৎ যখন
রমজান মাস শুরু হয় তখন আকাশের দরজা সমূহকে খুলে দেয়া হয় (অন্য জায়গায় রয়েছে জান্নাতের
দরজা সমূহকে খুলে দেয়া হয়)। জাহান্নামের দরজাসমূহকে বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানসমূহকে
শিকলবন্দী করা হয় (সহিহ আল বুখারি)। এরপর একটি হাদিস এরূপ, আনআবিহুরায়রাতা (রা.)
মানসামাশাহরু রামাদানা ঈমানাও ওয়া ইহুতেছাবাও গুফিরালাহু মা তাকাদ্দামা মিন জানি¦হী। অর্থাৎ
যে ব্যক্তি রমজান মাসের সাওম ঈমান ও ইহতেসাব অর্থাৎ আÍবিশ্লেষণের সাথে পালন করবে তাঁর অতীত
জীবনের পাপরাশি ক্ষমা করে দেয়া হবে (সহিহ আল বুখারি)। হাদিসে কুদসির বর্ণনা অনুযায়ী
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলে, আসসাওমুলী ওয়া আনা আজিযিবিহি, অর্থাৎ সাওম আমার জন্যই
রাখা হয় আর আমি স্বয়ং নিজে এর প্রতিদান দেবো (সহিহ আল বুখারি)।
ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবন ব্যবস্থাÑ এ জীবন পদ্ধতির মধ্যে এমন কোনো বিষয় নেই যা
মানুষের জন্য দুঃসাধ্য, অবাস্তব ও চলমান সমাজ তথা সভ্যতা বিকাশে অন্তরায়। মূলত সিয়াম সাধনা
মানুষের কর্মজীবনকে উচ্ছৃ´খলতা মুক্ত করে আল্লাহপ্রদত্ত জীবন ব্যবস্থার মাধ্যমে সভ্যতা, শিক্ষা,
সাংস্কৃতিক, জ্ঞান চর্চা ও গবেষণার দিকে ধাবিত করে। এটা বৌদ্ধ, জৈন ও অন্য যেকোনো
কৃচ্ছ্রতা তথা উপবাসের মাধ্যমে আÍাহুতি দেয়ার মতো কোনো মানব উদ্ভাবিত ধর্মমাত্র নয়।
সারা দিন কঠোর সিয়াম সাধনার পর সূর্যাস্তের সাথে সাথেই অনতিবিলম্বে ইফতার করার নির্দেশ
দিয়েছেন মহানবী (সা.)। এতে একজন মানুষ যেন দুর্বল হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়ে না ফেলে। এভাবে
একনাগাড়ে নফল সওম পালনকেও উৎসাহিত করা হয়নি। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুজাইফার উদ্ধৃতি তৎপুত্র
আওন (রা.) হযরত আবু দারদা ও হযরত সালমান (রা.) এর নফল সালাত ও সাওম পালনের একটি ঘটনার বিবরণ
দিয়ে মহানবী (সা.) এর একটি হাদিসের উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত সালমান (রা.) আবু দারদাকে
বিরতিহীন সাওম ও সারা রাত জেগে নফল সালাত আদায় করতে দেখে বলেছিলেন, আপনার প্রতিপালক
রবের আপনার ওপর হক রয়েছে। আপনার নিজের আÍার ওপর আপনার হক আছে এবং আপনার পরিবার পরিজনেরও
আপনার হক আছে। তাই প্রত্যেক হকদারকে তার হক আদায় করুন। এরপর আবু দারদা নবী (সা.) এর
নিকট আসলেন, কাজাকারা জালিকা ফাহু. ফাক্বয়ালান্নাবী (সা.) সাদাকা সালমানা অর্থাৎ আবু
দারদা এসব কথা নবী (সা.) এর কাছে বললেন, তখন নবী (সা.) বললেন, সালমান (রা.) ঠিক কথাই বলেছেন।
(সহিহ আল বুখারি)। এ ঘটনা থেকে ইসলামে মধ্যম পন্থী জীবন যাপনের সঠিক চিত্রই ফুটে উঠেছে।
মহানবী (সা.) সফরে সাওম ভেঙে ফেলতেন এবং পরবর্তীতে তা পূরণ করতেন। অসুস্থ ও মুসাফিরগণ
রমজান মাসেও সওম না রেখে সুবিধাজনক সময়ে তা রেখে দেয়ার বিধান পবিত্র কুরআনুল কারীমে
দেয়া হয়েছে। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন, অমান ক্বানা মারাদান আওআ’লা
সাফারিন ফাইদ্দাতুম মিন আইয়্যামিন উখারা ইউরিদুল্লাহু বিকুমুল ইউছরা আলবিকুমুল ঊছড়া …
অর্থাৎ আর যদি কেউ অসুস্থ হয় কিংবা ভ্রমণ কাজে ব্যস্ত থাকে তবে যেন অন্যান্য দিনে এই সিয়ামের
সংখ্যা পূর্ণ করে দেয়। মূলত আল্লাহ তোমাদের কাজকে সহজ করে দিতে চান। কোনোরূপ কঠোরতা
আরোপ আল্লাহর ইচ্ছা নয় (সূরা বাকারা আয়াত-১৮৫)। মহান রাব্বুল আলামীন আসলে চান তার
বান্দাহগণের নিরঙ্কুশ আনুগত্য তথা দাসত্ব। মানুষকে যে খিলাফাতের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সিয়াম
সাধনার মাধ্যমে তা পালনের পরিপূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করুক এটাই পবিত্র দ্বীন ইসলাম নামক জীবন
ব্যবস্থার লক্ষ্য।
বর্তমান বিশ্বের কিছু সংখ্যক ইসলাম বিদ্বেষী ব্যক্তি সিয়াম সাধনাসহ ইসলামের বিধানাবলীকে
যে অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক বলার মতো ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে তা নিছক নাস্তিক্যপ্রিয়তার ফলশ্রুতি
ভিন্ন আর কী হতে পারে?
হুম সুন্দার হইছে চালিয়ে যান।
ধন্যবাদ আপনাকেও কষ্ট করে কমেন্ট করার জন্য। আছি আপনাদের সাথে।