পরিচিতিঃ
হলুদ বাংলাদেশের সুপ্রাচীন প্রয়োজনীয় মসলা এবং একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য।দেশে উৎপাদিত মসলা ফসলের মধ্যে হলুদের স্থান তৃতীয়। আমাদের প্রতিদিনের রান্নায় হলুদের ব্যবহার হয় সবচেয়ে বেশী। মসলা হিসাবে ব্যবহার ছাড়াও অনেক ধরণের প্রসাধনী কাজে ও রং শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে হলুদ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে হলুদ চাষ হয় এবং শুকনা হলুদ হিসেবে এর মোট উৎপাদন প্রায় ৪১ হাজার টন। যা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। ফলন কম হওয়ার মূল কারণ উচ্চ ফলনশীল জাত এবং উৎপাদনের উন্নত কলাকৌশলেরঅভাব। উচ্চ ফলনশীল জাত এবং উৎপাদনের উন্নত কলাকৌশলব্যবহার করা হলে হলুদের ফলন দ্বিগুণেরও বেশি করা সম্ভব। মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা হলুদের উচ্চ ফলনশীল জাত এবং চাষাবাদের উন্নত পদ্ধতি বের করার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।হলুদের ইংরেজি নাম Turmeric এবং বৈজ্ঞানিক নাম Curcuma longa.
মাটি ও আবহাওয়াঃ
পানি নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ বা পলি মাটি হলুদ চাষের জন্য উত্তম। এইরুপ মাটি হলুদের কান্ড বৃদ্ধিতে সহায়ক। ক্ষার মাটিতে হলুদ ভালো হয় না। সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাসব্যাপী সপ্তাহে একবার বৃষ্টি হলে কন্দের আকার বৃদ্ধি পায়। সেকেন্ডারি কন্দের পার্শ্ব বিস্তৃতির জন্য ১০-১৫° সে. এবং কন্দ বৃদ্ধির জন্য ১৮-২০°সে. তাপমাত্রারপ্রয়োজনহয়।হলুদজাতীয়ফসলবৃষ্টিবন্ধহওয়ারতিনসপ্তাহপরসংগ্রহকরলেউন্নতমানেরশুকনোকন্দএবংসংরক্ষণগুণবৃদ্ধিপায়।অপেক্ষাকৃতআদ্রমাটিতেওহালকাছায়াযুক্তস্থানেহলুদভালোজন্মে।
জাতঃ
হালকা, গাঢ় হলুদ, কমলা ইত্যাদি বিভিন্ন রংয়ের হলুদ দেখা যায়। কারকিউমিনের পরিমাণের উপর হলুদের রং নির্ভর করে। মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত হলুদের তিনটি উচ্চ ফলনশীল জাত হচ্ছে (ক) বারি হলুদ-১ (ডিমলা), (খ) বারি হলুদ-২ (সিন্দুরী) ও (গ) বারি হলুদ-৩।
জীবনকালঃ
জাতভেদে ফসল সংগ্রহের জন্য ৭-৯ মাস সময়ের প্রয়োজন হয়। আগাম জাত ৭-৮ মাসে, মধ্যজাত ৮-৯ মাসে এবং নাবীজাত ৯ মাস পর উঠানো হয়। সাধারণত জানুয়ারি-মার্চ মাসে ফসল তোলা হয়।
বপন সময়ঃ
বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে (মধ্য এপ্রিল-মধ্য মে) জমিতে ‘জো’ আসলে জমি তৈরী করে হলুদ লাগিয়ে দেওয়া হয়।
জমি তৈরিঃ
বপনের প্রায় ১ মাস পূর্বে প্রয়োজনীয় জৈবসার প্রয়োগ করে এবং ৫-৬টি গভীর চাষ ও মই দিয়ে আগাছা বেছে জমি ভালোভাবে প্রস্তুত করতে হবে। সেচ ও পানি নিষ্কাশনের জন্য জমিকে বেশ কয়েকটি ব্লকে ভাগ করে ১-১.২ মিটার প্রস্থ ১৫ সেমি. উঁচু এবং প্রয়োজনমত লম্বা বেড তৈরি করতে হবে এবং দু’টি বেডের মাঝখানে ৫০-৭৫ সেমি প্রশস্ত নালা রাখতে হবে।
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতিঃ
হলুদ মাটি থেকে প্রচুর খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে। সুতরাং ভালো ফসলের জন্য বিশেষ করে হাল্কা মাটিতে প্রচুর পরিমাণে সার প্রয়োগ করা দরকার। হলুদ চাষের জন্য উল্লেখিত হারে সার প্রয়োগ করতে হয়-
সারের নাম |
সারের পরিমাণ/বিঘা |
ইউরিয়া |
২৫-৩০ কেজি |
টিএসপি |
২০-২৫ কেজি |
এমপি |
২০-২২ কেজি |
জিপসাম |
১৫-২০ কেজি |
জিংক অক্সাইড |
২৫০-৩০০ গ্রাম |
গোবর |
৫০০-৮০০ কেজি |
জমি তৈরির সময় অর্ধেক ইউরিয়া, এমপি, সমুদয় গোবর, টিএসপি, জিপসাম ও জিংক অক্সাইউ সার প্রয়োগ করতে হবে। বাকি ইউরিয়া ও পটাশ কন্দ লাগানোর ৬০ এবং ৯০ দিন পর চাপানো সার প্রয়োগ করতে হবে।
বীজ বপন পদ্ধতিঃ
মাটির প্রকৃতি ও বৃষ্টিপাত অনুসারে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পদ্ধতিতে হলুদ লাগানো হয়। প্রস্তুতকৃত জমিতে ২৫×৩০ সেমি দূরত্বে হলুদ লাগানো হয়। প্রধান কন্দের পার্শ্ব কন্দ থেকে বেশি ফলন হয়। ৭-৮ সেমি দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট অঙ্কুরিত চোখসহ পূর্ববর্তী বছরের নীরোগ, পুষ্ট ও নির্বাচিত কন্দ বীজ হিসেবে লাগান হয় (ফসল তোলার পর ২-৩ মাস স্তুপকৃত করে ঢেকে রেখে দিলে অঙ্কুরিত হতে থাকে)। বীজের জন্য জন্য গুড়ি অথবা পার্শ্ববর্তী কন্দ বা ফিংগার উভয়ই লাগানো যাবে। বীজ কন্দগুলিকে বপন করার পূর্বে ছত্রাকনাশক ঔষধ ডায়াথন এম-৪৫ দুই গ্রাম/লিটার দ্রবণে ৩০ মিনিট ব্যাপি ডুবিয়ে রেখে শোধন করে ছায়াতে শুকিয়ে বপন করা উচিত। বিঘা প্রতি ১৫০-২০০ কেজি মাতৃকন্দের প্রয়োজন হবে।
পরবর্তী পরিচর্যাঃ
বীজকন্দ লাগানোর দু’দিক থেকে মাটি চাপা দিয়ে খড় কুটো, লতাপাতা ইত্যাদি দিয়ে ঢেকে দিতে পারলে অঙ্কুরোগম ভালো হবে এবং আগাছা কম হবে। হলুদ লাগানোর ১৪-২১ দিনের মধ্যে হলুদের চারা মাটির উপর বের হয়ে আসে। এই সময় চারার সাথে আগাছাও জন্মাতে থাকে। নিড়ানী দিয়ে আগাছা পরিষ্কার রাখতে হবে। প্রয়োজনে ৩০-৩৫ দিন পরপর ১-২ বার নিড়ানি দিয়ে মাটি আলগা করে দেওয়া ও দু’দিক থেকে মাটি উঠিয়ে দেওয়া যেতে পারে। তাতে বর্ষাকালে পানি নিষ্কাশন সুবিধা হয় এবং কন্দ ভালোভাবে বৃদ্ধি পায়। ভালো ফলন পেতে হলে হালকা সেচ দেওয়া, রোগ-পোকার আক্রমণের দিকে সজাগ দৃষ্টি রেখে প্রয়োজনীয় কীটনাশক প্রয়োগ করা উচিৎ। মাটির নিমাটোড বা কৃমি রোগ থেকে ফসল রক্ষার জন্য ফসল চক্র অনুসরণ করতে হবে।
মরিচ, বেগুন, টমেটো এবং আলু জাতীয় ফসল চাষ করা হলে এমন জমিতে হলুদ চাষ করা উচিত নয়।
পোকামাকড় ও রোগ দমনঃ
হলুদে পোকার আক্রমণ খুবই কম। তবে মাঝে মধ্যে থ্রিপসের আক্রমণ দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে ডাইমেক্রন অথবা ম্যালাথিয়ন প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে।
সেচঃ
সাধারণত বৃষ্টি নির্ভর ফসল হিসাবেই আমাদের দেশে হলুদের চাষ হয়। সার প্রয়োগের পর বৃষ্টি না হলে সেচ দেওয়া হয়। বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে মাঝে মাঝে সেচ দিতে হয়।
ফসল তোলাঃ
হলুদ লাগানোর ২৭০-৩০০ দিন পর তোলার উপযুক্ত হয়। ফসল পাকলে গাছের পাতা শুকিয়ে মাটির সাথে নেতিয়ে পড়ে। কোদাল অথবা লাঙ্গল দিয়ে কন্দ তোলার পর মাটি ও শিকড় ফেলে দিয়ে হলুদ পরিষ্কার করে মজুদ করা হয়।
ফলনঃ
মাঠ থেকে উত্তোলিত পরিস্কার কাঁচা হলুদ বিঘা প্রতি ২০০০-২৫০০ কেজি পাওয়া যায়। সঠিক সময়ে বপন, সার, সেচ ও নিয়মিত পরিচর্যা করলে জাতভেদে ২৫০০-৪৫০০ কেজি পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। কাঁচা হলুদ সিদ্ধ করে শুকানোর পর কাঁচা হলুদের এক চতুর্থাংশ ওজনের শুকনা হলুদ পাওয়া যায় (বিঘা প্রতি ৫০০-৬৫০ কেজি)।
সূত্রঃ মরিচ,পেঁয়াজ,রসুন,হলুদ ও আদা উৎপাদনের উন্নত কলাকৌশল (বারি)।