আদা বাংলাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ মসলা ফসল। এই কাঁচা, শুকনা ও সংরক্ষিত অবস্থায় খাওয়া হয়ে থাকে। বিভিন্ন ঔষধি গুণ সম্পন্ন এই ফসল অন্ত্রের রোগ ও সর্দি কাশি প্রভৃতি রোগ নিরাময়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। টাটকা আদায় প্রতি ১০০ গ্রামে ২.৩ গ্রাম প্রোটিন, ১২.৩ গ্রাম শ্বেতসার, ১.০ গ্রাম উদ্বায়ী তেল, ২.৪ গ্রাম আঁশ, ১.২ গ্রাম খনিজ পদার্থ, ৮০.৮ গ্রাম পানি, রেজিন ইত্যাদি উপাদান বিদ্যমান। বাংলাদেশের কৃষক পর্যায়ে আদার গড় ফলন ৮০০ কেজি/বিঘা। দেশে প্রতি বছর আদার চাহিদা ৯৬ হাজার মেট্রিক টন ও উৎপাদন ৪৩,০০০ মেট্রিক টন, যা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। ফলন কম হওয়ার মূল কারণ উন্নত জাত ও বৈজ্ঞানিক উৎপাদন পদ্ধতির অভাব।

মাটি ও আবহাওয়াঃ

পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাযুক্ত অধিক জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ আর্দ্র ও উর্বর দোঁ-আশ মাটি আদা চাষের জন্য উপযুক্ত। পানি নিকাশের উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকলে এঁটেল মাটিতেও আদার চাষ করা যায়। উষ্ণ ও আদ্র আবহাওয়া আদা চাষের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। আদা চাষের জন্য মাটিতে যথেষ্ট রস ও হালকা ছায়া থাকা প্রয়োজন।

জমি তৈরিঃ

লম্বা ও আড়াআড়িভাবে ৫-৬টি চাষ মই দিয়ে ঢেলা ভেঙ্গে মাটি ভালভাবে ঝুরঝুরে করা উচিৎ। এরপর ৪ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ২ মিটার প্রস্থ বেড করার পর চারিদিকে ১-১.৫ ফুট গভীর নালা করে নালার মাটি বেডের উপর দিয়ে উঁচু করতে হয়। পানি সেচ ও নিষ্কাশনের সুবিধার জন্য দুটি বেডের মাঝখানে ৫০ সেমি প্রশস্ত নালা থাকলে ভাল হয়। আগাছা, শিকড় ইত্যাদি উপড়ে ফেলে জমি পরিষ্কার করতে হবে।

বপন সময়ঃ

খরিপ মৌসুমে আদার চাষ হয় এবং রবি মৌসুমের শেষের দিকে ফসল সংগ্রহ করা হয়। গ্রীষ্মকালীন বৃষ্টি আরম্ভ হওয়ার সাথে সাথেই জমি তৈরী করে এপ্রিল-মে (চৈত্র-বৈশাখ) মাসে আদা লাগাতে হয়। বৃষ্টি হতে বিলম্ব হলে সেচ প্রযোগ করে জো অবস্থায় এনে আগাম অথবা দেরিতে জুন (জৈষ্ঠ্য) মাসেও আদা লাগানো যেতে পারে। আদা গাছের দৈহিক বৃদ্ধির ৩-৪ মাস পর রাইজম উৎপন্ন হয়। এ কারণে দেরিতে রোপণকৃত আদা গাছে যথাযথ বৃদ্ধি না হওয়ার জন্য ফলন কম হয়।

বীজ আদা ও শোধনঃ

বীচ হিসেবে সতর্কতার সহিত বীজ রাইজোম ২.৫-৫ সেমি দৈঘ্য রেখে ২০-২৫ গ্রাম ওজনের এক থেকে দুটি ভালো চোখ বিশিষ্ট ছোট ছোট খন্ডে কাটা হয়। এরপর ১০০ কেজি কাটা রাইজোম খন্ড ৭০-৮০ লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ মিশিয়ে এর মধ্যে ৩০ মিনিট ডুবিয়ে রেখে ছায়ায় শুকিয়ে বপন করা হয়।

রোপণ পদ্ধতি ও বীজের হারঃ

২৫ সেমি দূরত্বে সারি করে ২০ সেমি ব্যবধানে ৩০-৪০ গ্রাম ওজনের দু’তিনটি চোখসহ বীজ আদা ৫-৬ সেমি গভীর করে লাগাতে হয়। এতে বিঘা প্রতি ৪০০ কেজি আদার প্রয়োজন। নির্ধারিত বীজ ঠান্ডা ও ছায়াযুক্ত স্থানে বালির উপর স্তুপীকৃত করে রাখলে ২-৩ মাস পর অঙ্কুরোদগম হয় এবং পরে বীজ হিসাবে লাগানো হয়।

সারের মাত্রাঃ

ভাল ফলন পেতে হলে নিম্ন পরিমাণে সার প্রয়োগ করতে হবে-

সার মোট পরিমাণ (বিঘা প্রতি) কেজি জমি তৈরীর সময় দেয় ১ম কিস্তি রোপনের ৫০ দিন পর ২য় কিস্তি রোপনের ৯০ দিন পর ৩য় কিস্তি রোপনের ১২০ দিন পর
গোবর ৯০০-১০০০ সব
ইউরিয়া ৩০ সব ১৫ কেজি ৭.৫ কেজি ৭.৫ কেজি
টিএসপি ২৪ সব
এমপি ২৬ ১৩ কেজি ৬.৫ কেজি ৬.৫ কেজি
জিপসাম ১০ সব
জিংক সালফেট ০.৪ সব

আদা জমি থেকে প্রচুর খাদ্য উপাদান তুলে নেয় বলে, ভাল ফলন পাবার জন্য উপযুক্ত পরিমাণ জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। জমি চাষের সময় গোবর মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।

পরিচর্যা

আদা রোপনের ৪ ও ৮ সপ্তাহ পর জমির আগাছা নিড়িয়ে দিতে হবে। গাছের গোড়ার মাটি ২-৩ বার তুলে সারি বরাবর দিতে হবে। এর ফলে যে নালা তৈরি হবে তা সেচ ও পানি নিষ্কাশনের কাজে লাগে।

পিলাই তোলাঃ

আদা রোপনের পর গাছ হয়ে গেলে বীজ আদা তুলে নেওয়া যায়। এত গাছের কোন ক্ষতি হয় না। উপরোন্ত কিছু আর্থিক লাভ হয়। এই পদ্ধতিটিকে পিলাইতোলা বলে। বীজ আদা লাগানোর সময় সবগুলো বীজের অংকুরিত মুখ একদিকে রাখতে হয় যাতে বীজ আদা রোপনের ৭৫-৯০ দিন পর সারির এক পাশের মাটি সরিয়ে সহজেই পিলাই সংগ্রহ করা যায়। এভাবে বীজের খরচ ৫০-৬০ ভাগ উঠে আসে।

সেচঃ

পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টি না হলে সেচ দেওয়া প্রয়োজন। আদার জমিতে এমনভাবে সেচ দিতে হবে যাতে জমিতে পরিমিত রস থাকে কিন্তু জমি অতিরিক্ত ভিজে না যায়।

মালচিং

আদা রোপনের পর পাতা/খড় দিয়ে জমি মালচিং করা হয়। এত জমির রস সংরক্ষিত থাকে ও ভূমি ক্ষয় রোধ হয়। কিছু দিন পর এসব পাতা/খড় পচে গিয়ে জমিতে জৈব উপাদান বৃদ্ধি করে। আদা গাছ কিছুটা ছায়া পছন্দ করে বলে ছায়া যুক্ত স্থানে বীজ লাগানো যায়। তাছাড়া শন, কলাই, গাইমুগ, শীম, বরবটি ইত্যাদি গাছ দিয়েও আচ্ছাদন দেওয়া যেতে পারে।

ফসল চক্র এবং মিশ্র ফসলঃ

আদা অন্য ফসলের (আনারস, মরিচ, ধান, ভূট্টা, বাদাম ও অন্যান্য সবজি জাতীয়) সাথে মিশ্র ফসল হিসেবে চাষ করা যায়। এমনকি আন্তঃফসল হিসেবে নারিকেল, খেজুর ও সুপারি বাগানে ভালোভাবে চাষ করা যায়।

ফসল তোলাঃ

সাধারণত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে আদা তোলা হয়। আদা রোপনের ৭-৮ মাস পরেই আদা তোলার সময় হয়। ফসল পাকলে গাছের পাতা ক্রমশ হলদে হয়ে ডাটা শুকাতে শুরু করলে আদা তুলে, মাটি ঝেড়ে পরিষ্কার করে সংরক্ষণ করা হয়।

ফলনঃ

সাধারণত প্রতি বিঘায় ৪০০০-৪৫০০ কেজি ফলন পাওয়া যায়।

বীজ আদা সংরক্ষণঃ

বড় আকারের বীজ রাইজোম ছায়াযুক্ত স্থানে মাটির নীচে পিট তৈরি করে গুদামজাত করা হয়। ৬-৮ মাস বয়সের সুস্থ ও রোগমুক্ত রাইজোম মাঠ থেকে বাজারে নেওয়ার পূর্বে শুধুমাত্র বীজ আদা সংগ্রহ করা হয়। পিটে সংরক্ষণ করার পূর্বে শুধুমাত্র বীজ আদা সংগ্রহ করা হয়। পিটে সংরক্ষণ করার পূর্বে বীজ আদা ০.১% কুইনালফোস এবং ০.৩% ডায়াথন এম-৪৫ এর দ্রবণে শোধন করা হয়। দ্রবণযুক্ত রাইজোম ছায়ায় শুকানো হয়। পিটের দেয়ালের চারিদিক গোবরের তৈরি পেস্ট দিয়ে প্রলেপ দিয়ে শুকিয়ে আদা রাখা হয়। প্রতি স্তরে আদার উপর ২ সেমি পুরু শুকনো বালি বা করাতের গুড়া দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। বায়ু চলাচলের জন্য পিটের উপরিভাগের ও পাশে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাঁকা জায়গা রেখে দেওয়া হয়। ২০-৩০ দিন পরপর রোগাক্রান্ত রাইজোম বেছে ফেলা দেয়া হয়। কিছু কিছু এলাকায় ছায়ার নীচে স্তুপ করে বালি/তুষ দিয়ে বা শুকনো পাতা দিয়ে ঢেকে আদা সংরক্ষণ করে।

 

 

সূত্রঃ মরিচ,পেঁয়াজ,রসুন,হলুদ ও আদা উৎপাদনের উন্নত কলাকৌশল (বারি)।

ginger, ginger cultivation, ‍spice, Spice cultivation